জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, ভাষা আন্দোলনের নেতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার অধ্যাপক গোলাম আযম গত ১১ জানুয়ারি ২০১২ আদালতে হাজির হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে যাওয়ার আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, আমি অত্যন্ত দৃার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে দাবী করছি যে এসব অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। নিরপেক্ষ বিচার হলে এগুলোর একটিরও প্রমাণ পাওয়া যাবে না। আমি জেল, জুলুম, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। তিনি বলেন, হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই বিচারের নামে এ প্রহসন চলছে। এ মামলার বাদী বর্তমান সরকার। আসামীদের অপরাধের তদন্ত করার জন্য যে সংস্থা, তা এ সরকারই তাদের নিজেদের লোকদের সমন্বয়ে গঠন করেছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যে সেক্যুলার সরকার কায়েম হয়েছে, তারা আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের চরম বিরোধী। তাই তারা বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিকে বেআইনী ঘোষণা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ জঘন্য উদ্দেশ্যেই ১৯৭৩ সালের মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর দোহাই দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে তাদের মনগড়া ট্রাইব্যুনালে এক জংলী আইনে বিচার করে শাস্তি দেয়ার চক্রান্ত করছে।
গত ১১ জানুয়ারি ২০১২ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে যাওয়ার পূর্বে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত একটি বক্তব্য তার একান্ত সচিব নাজমুল হকের নিকট হস্তান্তর করে যান। আদালতে হাজির হতে যাওয়ার পূর্বে তিনি যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা জনগণের অবগতির জন্য বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সকল মিডিয়ায় প্রকাশ করার জন্য প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে পাঠানো হয়।
জাতির উদ্দেশে অধ্যাপক গোলাম আযমের দেয়া বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলো :
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া-নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, ওয়া-আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন
আমার প্রিয় দেশবাসী,
আসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
বাংলাদেশে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যে সেক্যুলার সরকার কায়েম হয়েছে, তারা আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েমের চরম বিরোধী। তাই তারা বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিকে বেআইনী ঘোষণা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ জঘন্য উদ্দেশ্যেই ১৯৭৩ সালের মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর দোহাই দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে তাদের মনগড়া ট্রাইব্যুনালে এক জংলী আইনে বিচার করে শাস্তি দেয়ার চক্রান্ত করছে।
ঐ আইন অনুযায়ী গঠিত তদন্ত সংস্থা আমার বিরুদ্ধে ৬২টি অভিযোগ এনেছে। জেলে নেয়ার পর এক তরফা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার বন্যা বইতে থাকবে। আমার কোনো বক্তব্য জনগণের নিকট পৌঁঁছাবার সামান্য সুযোগও থাকবে না। তাই গ্রেফতার হওয়ার সাথে সাথেই যাতে আমার বক্তব্য জনসাধারণ অবগত হতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই আমি আমার এ বক্তব্য পেশ করছি। সম্প্রতি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করলেও যেহেতু সেগুলোতে আমার সকল বক্তব্য আসেনি, তাই এ ব্যবস্থা করেছি।
প্রিয় দেশবাসী,
২০১১ সালের নভেম্বরে আমার ৮৯ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। বার্ধক্যে রোগের অন্ত থাকে না। আমার ডান পায়ে সায়াটিকা ও বাম হাঁটুতে আর্থরাইটিস। এর জন্য দু’বেলা এমন কতক ব্যায়াম করতে হয়, যা অন্য কারো সাহায্য ছাড়া করা যায় না। একা চলাফেরা করতে পারি না। ডান হাতে ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাম হাত একজনের কাঁধে রেখে মসজিদে যেতে হয়। তাই অত্যাবশ্যক না হলে কোথাও যাই না। ব্লাডপ্রেসারসহ নানা অসুখের কারণে রোজ নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। এ অবস্থায়ও সরকার ৯০ বৎসর বয়সে আমাকে জেলে নিচ্ছে। আমি জীবনে চারবার জেলে গিয়েছি। জেল বা মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনা। আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পাইনা। শহীদ হওয়ার জযবা নিয়েই ইসলামী আন্দোলনে শরিক হয়েছি। মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দিলে শহীদ হওয়ার মর্যাদা পাবো ইনশাআল্লাহ। এবার বার্ধক্যে ও অসুস্থতা নিয়ে বন্দিজীবন কেমন করে কাটবে সে ব্যাপারে মহান মাবুদের উপর ভরসা করে আছি।
আপনারা অবহিত আছেন যে, ১১ বৎসর পূর্বে, ২০০০ সালে, আমি স্বেচ্ছায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর-এর পদ হতে অব্যাহতি নেয়ার পর কোনো রাজনৈতিক বিবৃতি দিই না। কিন্তু, বিগত কিছু দিন থেকে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা, ভিত্তিহীন, কালনিক ও বানোয়াট খবর, কেবলমাত্র বিদ্বেষ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে নির্লজ্জভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তাই, সত্য প্রকাশের তাড়নায় আমি আপনাদের সামনে এ বক্তব্য পেশ করতে বাধ্য হলাম।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি জন্মগতভাবে এ দেশের নাগরিক। ১৯২২ সালে ঢাকার লক্ষীবাজারে আমার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করি। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট ঢাকা থেকে পাস করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমি ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হই। ১৯৪৭-৪৮ ও ৪৮-৪৯ সালে পরপর দু’বছর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমি ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদেরও জিএস ছিলাম। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবযাদা লিয়াকত আলী খানের নিকট আমিই পেশ করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৪৮-৫০ সালে আমি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম এবং পরবর্তীতে রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনাকালে ১৯৫২ ও ১৯৫৫ সালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য আমি দু’বার কারাবরণ করি।
১৯৫৪ সালে আমি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করি এবং প্রত্যক্ষভাবে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু করি। অখণ্ড পাকিস্তানে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমি সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। কপ (COP- Combined Opposition Party), পিডিএম (PDM- Pakistan Democratic Movement), ডাক (DAC- Democratic Action Committee) ইত্যাদি আন্দোলনে জনাব শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য সকল দলের নেতাদের সাথে অংশগ্রহণ করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি। রাজনৈতিক কারণে ১৯৬৪ সালেও আমাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর আমি বিবৃতি দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে অভিনন্দন জানাই। সেই সাথে কালবিলম্ব না করে বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট-এর নিকট আহবান জানাই। এরপর আসে মার্চ ১৯৭১।
১৯৭১-এর মার্চ মাসের ঐ উত্তাল দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়ার সাথে শেখ সাহেবের আলোচনার সময় আমার সাথে শেখ সাহেবের একান্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও বর্তমান স্থানীয় সরকার মন্ত্রী জনাব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-এর পিতা জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং জনাব আব্দুস সামাদ আযাদ-এর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাঁরা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, অখন্ড পাকিস্তান-এর চিন্তা নিয়েই উনারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। জনাব আব্দুস সামাদ আযাদের সাথে ২৫শে মার্চেও আমার টেলিফোনে আলোচনা হয়। তিনি আমাকে পুনরায় আশ্বস্ত করে বলেন যে, তাঁরা অখণ্ড পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোন বিকল্প চিন্তা করছেন না।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় তা থেকে বোঝা গেল যে, ইয়াহইয়া-মুজিব সংলাপ ব্যর্থ হয়ে গেছে। পরে জানা গেল যে, ’৭০-এ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু শেখ সাহেব পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। ইচ্ছা করলে তিনিও ভারতে চলে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাননি। শেখ সাহেব গ্রেফতার হওয়ায় তাঁর কথা কিছুই জানা গেল না। অন্যদিকে বোঝা গেল যে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারত সরকারের সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করতে চান। এদিকে, ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী নেতৃবৃন্দ ভারতে চলে যাওয়ায় অসহায় নির্যাতিত জনগণ আত্মরক্ষার জন্য দেশে অবস্থানরত আমাদের মত রাজনৈতিক নেতাদের নিকটই ধরণা দিতে বাধ্য হলো।
১৯৪৭ সাল থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত ভারত সরকার এ দেশের সাথে যে আধিপত্যবাদী আচরণ করেছে তাতে আমাদের নিশ্চিত এ বিশ্বাস ছিল যে, ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশ স্বাধীন হলে তা ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রই হবে। তাই, কিছু বামপন্থী, সকল ডানপন্থী ও সকল ইসলামী দলগুলোসহ প্রায় সকল সুপরিচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব এ সুস্পষ্ট ধারণার কারণেই ভারতের সাহায্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সঠিক মনে করেননি। ভারতের সাহায্য না নিয়ে যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ করা হতো, তাহলে আমরা অবশ্যই সে যুদ্ধে যোগদান করতাম।
ভারত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ও ১৯৭০-এ নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য জনাব নুরুল আমীনের বাসায় সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানাতে হবে এবং সেনাবাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের শিকার অসহায় জনগণের সহায়তার জন্য আমাদেরকে সুযোগ দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই অনুযায়ী আমরা ৭/৮ জন একসাথেই টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করি। পিডিপি’র জনাব নূরুল আমীন, জামায়াতে ইসলামী থেকে আমি, নেজামে ইসলাম পার্টির মৌলভী ফরিদ আহমদ, মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দীন, কেএসপি’র এ এস এম সুলাইমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ তাতে সামিল ছিলেন। এখন ঐ মিটিং-এর ছবির বরাত দিয়ে আমার নামে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। উনাদের কি ধারণা যে, ছবি কথা বলে? তাহলে শেখ সাহেবের সাথেও তো আমার এবং মাওলানা মওদূদী (র)-এর মিটিং-এর ছবি আছে। সেগুলোর আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল তা কি তারা বলতে পারবেন?
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারা রাজনৈতিক নেতাগণ জনগণকে যুলুম থেকে রক্ষা করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনে বিজয়ী নেতৃবৃন্দ দেশে না থাকায় সাহায্যপ্রার্থী অসহায় জনগণের সমস্যার সমাধান করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও চেষ্টা ছিল। আমিও এ চেষ্টাই করেছি। আমি ১৪ আগস্ট ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক মিটিং-এ সেনাবাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিকার দাবী করেছিলাম। বায়তুল মোকাররমের সামনে আরেকটি মিটিং-এও আমি এই প্রতিবাদ ও প্রতিকার দাবি উত্থাপন করেছিলাম। আমার বক্তব্য পত্রিকায় আসতে দেয়া হয়নি; বক্তব্য প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্থপতি স¡য়ং যুদ্ধাপরাধী ব্র্যুর চূড়ান্ত মীমাংসা করে গেছেন
শেখ সাহেব এর সরকার তদন্তের মাধ্যমে পাক-সেনাবাহিনী ও সহযোগী অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে থেকে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন। তাদের বিচার করার জন্য ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই জাতীয় সংসদে International Crimes (Tribunals) Act পাস করা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে ঐ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করা হয়। শেখ সাহেব বাংলাদেশের কোন বেসামরিক ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় শামিল করেননি। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং যারা সেনাবাহিনীর সহযোগী হয়েছিল, তাদেরকে শেখ সাহেবের সরকার ‘কলাবরেটর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের সামরিক সরকার সরকারি আদেশের মাধ্যমে জনগণ থেকে রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস নামে বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে।
এসব বাহিনীকেও শেখ সাহেব এর সরকার ‘কলাবরেটর’ আখ্যা দেন। ‘কলাবরেটরদেও’ বিচার করার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘কলাবরেটর্স অর্ডার’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ আইনে বিচারের জন্য লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। এদের মধ্যে অভিযোগ আনা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪শ’ ৭১ জনের বিরুদ্ধে। এই অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬শ’ ২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে কোন মামলা দায়েরই সম্ভব হয়নি। মাত্র ২ হাজার ৮শ’ ৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭শ’ ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। পরবর্তীতে, ১৯৭৩ সালের নবেম্বরে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর গ্রেফতারকৃত ও সাজাপ্রাপ্ত সকলেই মুক্তি পায়। অবশ্য যারা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মত অপরাধে অপরাধী তাদেরকে ঐ আইনে বিচার করার সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু, এরপর দু’বছর পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে ঐসব অভিযোগে মামলা দায়ের না হওয়ায় এ আইনটিই বিলুপ্ত করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে সে সময় অভিযোগ উঠেনি, কোন মামলা দায়ের হয়নি, সেই নিরপরাধীদেরকেই যুদ্ধাপরাধী সাজাবার জন্যে আজ মামলা তালাশ করা হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর উদ্ভাবন
১৯৮০’র দশকে এবং ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। সকল আন্দোলনকারী দলের লিয়াজোঁ কমিটি একত্রে বৈঠক করে কর্মসূচি ঠিক করতো। তখন তো কোন দিন আওয়ামী লীগ জামায়াত নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধী মনে করেনি। ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ জামায়াতের সহযোগিতা প্রার্থনা করে আমার নিকট ধরনা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতা আমির হোসেন আমু সাহেব জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ সাহেবের মাধ্যমে আমাকে মন্ত্রী বানাবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তখনও তো আওয়ামী লীগের মনে হয়নি যে, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধী! পরবর্তীতে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী জামায়াতের সমর্থন লাভের আবদার নিয়ে যখন আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখনও তো তাদের দৃষ্টিতে জামায়াত নেতৃবৃন্দ ‘যুদ্ধাপরাধী’ ছিল না। এরপর এমন কী ঘটলো যে আওয়ামী লীগ ও কতক বাম দল জামায়াতকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ আখ্যা দিয়ে জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য জেহাদে নামলেন? এরূপ দু’মুখো নীতি কোনো সুস্থ রাজনীতির পরিচয় বহন করে না।
২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৫৮টি আসনে বিজয়ী হয় আর বিএনপি ১৯৭টি আসন পায়। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হওয়ায় নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলসমূহের শতকরা ২০ ভাগ ভোট একতরফা বিএনপি পাওয়ায় এসব ভোট থেকে বঞ্চিত হয়ে আওয়ামী লীগ মাত্র পাঁচ হাজার থেকে বিশ হাজার ভোটের ব্যবধানে বহু আসন হারায়।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার কারু হিসেবে বুঝতে পেরেছিল যে, জামায়াতে ইসলামীকে ঘায়েল করতে না পারলে ভবিষ্যতে নির্বাচনে বিজয়ের কোনো আশা নেই। এ উপলব্ধি থেকেই ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে জামায়াত নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধীর অপবাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ব্যাপক প্রচারাভিযান চালায়। যাদেরকে এক সময় ‘কলাবরেটর’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল তাদেরকেই এখন আওয়ামী লীগ ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে বিচার করতে চাচ্ছে। ২০০১ সালের পূর্বে কখনো জামায়াত নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা হয়নি। এখন পাকিস্তানী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচার করার জন্য ১৯৭৩ সালে যে আইন করা হয়েছিল সে আইনেই আওয়ামী লীগ নতুনভাবে আমাদেরকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়ে বিচার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এর আগে আওয়ামী লীগ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১, মোট দু’বার ক্ষমতায় ছিল। তখনতো তারা আমাদের এ আখ্যাও দেয়নি এবং ঐ আইনে বিচারের উদ্যোগও নেয়নি। সেটা কেন নেয়নি এর কি কোনো সন্তোষজনক জবাব আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে দিয়েছে বা দিতে পারবে?
এ বিচারের অসাধু উদ্দেশ্য
এ বিচারের অপচেষ্টার উদ্দেশ্য আসলে মোটেও সৎ নয়। হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই বিচারের নামে এ প্রহসন চলছে। জামায়াতকে নেতৃত্ব শূন্য করে যাতে আগামী নির্বাচনে জামায়াত আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারু হতে না পারে সে উদ্দেশ্যেই এ বিচার।
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর যে মীমাংসা শেখ সাহেব স্বয়ং করে গেছেন তা নাকচ করে নতুনভাবে বিচার করাই যদি আসল উদ্দেশ্য হতো, তাহলে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার আগে করতে হতো। কিন্তু সেটা সরকার করছে না। শেখ সাহেবের সমাপ্ত করা সে বিচার নাকচ না করেই অন্যায়ভাবে গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে সরকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতকে দুর্বল ও জামায়াত নেতৃবৃন্দকে দৃশ্যপট থেকে সরানোর জন্যেই নতুন করে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু সৃষ্টি করেছে।
যে আইনে বিচার করা হচ্ছে
যে কালো আইনে বিচার করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে সে আইনে ন্যায় বিচারের পরিপন্থী ১৭টি ধারা আন্তর্র্জাতক আইনজীবী সমিতি চিহ্নিত করেছে। হোটেল সোনারগাঁও-এ অনুষ্ঠিত আইনজীবী সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতম আইনজীবী বিচারপতি টিএইচ খান বলেছেন, ‘এ আইনটি চরম জংলী আইন। কুরবানীর পশুকে যেভাবে বেঁধে জবাই করা হয়, এ আইনে সেভাবেই বিচার করা হবে। আইনটির শিরোনামে আন্তর্জাতিক শব্দটি থাকলেও এ আইনে আন্তর্জাতিক মানের কোন চিহ্নও নেই।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে, যাতে আইনটি সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হয়। কিন্তু, সরকার এ সব কথায় কান দিচ্ছে না; কারণ যুদ্ধাপরাধ আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে ন্যায় বিচার করা হলে জামায়াত নেতৃবৃন্দের মত নিরপরাধ কাউকে সাজা দেয়া যাবে না এবং জামায়াতকে পথ থেকে সরানোর তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।
১৩ অক্টোবর ২০১০ তারিখে হোটেল সোনারগাঁও-এ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন আয়োজিত সেমিনারে যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যুগোস-াভিয়া ও রুয়ান্ডার আইনজীবী স্টিফেন কেয়ি কিউসি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বর্তমান যুদ্ধাপরাধ বিচার সম্পর্কে তার অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি সে সেমিনারে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও যুদ্ধাপরাধ আইনকে বাংলাদেশের সংবিধান, ফৌজদারী দণ্ডবিধি ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটাকে নিরপেক্ষ আইন ও নিরপেক্ষ বিচারিক প্রক্রিয়া বলে গণ্য করবে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মানে করতে হলে সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে করতে হবে, বিচারক হতে হবে উভয়পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিক মানের নিরপেক্ষ বিচারকও সেখানে থাকতে হবে। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তিকে এমন কোনো অপরাধের জন্য সাজা দেয়া যাবে না, যা কিনা তৎকালীন সময়ে কোনো আইন দ্বারা ঐ অপরাধকে চিহ্নিত করা হয়নি।
প্রহসনমূলক বিচার
এ মামলার বাদী বর্তমান সরকার। আসামীদের অপরাধের তদন্ত করার জন্য যে সংস্থা, তা এ সরকারই তাদের নিজেদের লোকদের সমন্বয়ে গঠন করেছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারকদেরকেও এ সরকারই বাছাই করে নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দান করেছে। একদিকে আইনের দুর্বলতা, অন্যদিকে নিজেদের মনোনীত দলীয় লোকদের দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তদন্ত ও বিচার। এ অবস্থায় ন্যায় বিচারের সামান্য সম্ভাবনাও থাকতে পারে না।
তদন্ত সংস্থা তাদের সাজানো লোকদেরকেই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে সুযোগ দিচ্ছে। ওয়াকিবহাল ও নিরপেক্ষ সাক্ষ্যদাতাদেরকে পুলিশ দিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার কথাও জানা গেছে। এটা এক হাস্যকর তদন্ত প্রক্রিয়া। আসলে নিরপেক্ষ তদন্ত তারা করতে চায় না। সরকারের রায় হয়েই আছে। ঐ রায়কে ঠিক রাখার জন্যে যে ধরণের তদন্ত দরকার সেটাই করা হচ্ছে। তাই, সরকারের পছন্দ মত বিচার ও রায় ঘোষণা হবার আশংকাই বেশি।
আমার সম্পর্কে তদন্তের নমুনা
তদন্ত সংস্থা কিছুদিন আগে আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। এতে একটি অভিযোগ আমার যে, আমি নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গণহত্যার হুকুমদাতা। অথচ ১৯৭১ সালে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাইইনি। আরো অভিযোগ করেছে, আমার পরামর্শেই নাকি সামরিক সরকার রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করেছে। স্বাধীনতার পর আমি নাকি পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার বা রক্ষা কমিটি গঠন করেছিলাম। এর প্রমাণ তারা কোথায় পেলেন? আসলে তারা যা বলছে তাকেই তারা প্রমাণ বলতে চায়। এগুলো সবই অপবাদ, অভিযোগ নয়। তদন্ত সংস্থা আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছে এসবই সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, কালনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যারা রাজনৈতিকভাবে আমাকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ তারাই নিজস্ব হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এ জঘন্য পন্থা বেছে নিয়েছে । আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে দাবি করছি যে এসব অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। নিরপেক্ষ বিচার হলে এগুলোর একটিরও প্রমাণ পাওয়া যাবে না। আমার সারা জীবনে আমি কখনো কোনো খারাপ কাজ করা তো দূরের কথা, কোনো খারাপ কাজের চিন্তাও আমার মাথায় আসেনি। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবসহ এ দেশের সকল বর্ষীয়ান ব্যক্তি আমার এ দাবির পক্ষেই কথা বলবেন। যারা আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার তারাও জানেন যে, এ সকল অভিযোগই সম্পূর্ণ মিথ্যা।
ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা আমার বিরুদ্ধে যে সব অপবাদ ও মিথ্যা তথ্য লিখে প্রচার করেছে সেসব তথ্যই ঐ জংলী আইনে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার বিধান রয়েছে, যাতে বিচারে সরকারের মনমতো শাস্তি দেয়া যায়। তাই, এ আইনে বিচার হলে সুবিচারের কোনো আশাই করা যায় না।
বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত তাদের সেনাবাহিনীর ভূমিকাকেই বড় করে দেখে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কৃতিত্ব সবটুকুই ভারত তাদের বলে মনে করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে তারা স্বীকারই করে না। তাই, ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে সেখানে হাজির হতেই দেওয়া হয়নি। প্রায় এক লাখ বন্দী পাকিস্তানী সৈন্যকে বাংলাদেশে না রেখে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাক বাহিনীর সকল অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম লুট করে ভারতে নিয়ে গিয়েছিল তারা। অথচ, এসব বাংলাদেশের সম্পদ ছিলো। বাংলাদেশ রেলওয়েসহ অন্যান্য সংস্থার সম্পদও ভারত লুট করে নিয়ে যায়। এমনকি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোও তাদের লুণ্ঠনের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
আসলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ভারত এগিয়ে আসেনি। তাদের চিরশত্রু পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের কুক্ষিগত করে রাখার উদ্দেশ্যেই তারা সবকিছু করেছে। তাদের পরবর্তী আচরণ সে কথাই প্রমাণ করে। দেশবাসী বিবেচনা করে দেখুন, ১৯৭১ সালে ভারতীয় আধিপত্যের যে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিলো তা সত্যে পরিণত হচ্ছে কিনা? বিগত ৪০ বৎসরের ইতিহাস এ সত্যের এক জ্বলন্ত সাক্ষী।
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষশক্তি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি বিদ্রোহীদেরকে অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করতো না, আমাদের পানি সম্পদ নিয়ে আমাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করতো না বা বর্ষায় পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করতো না। ভারতের পণ্য বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করেছে। সীমান্তে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশী মানুষকে পাখি শিকারের মতো গুলী করে হত্যা করছে ভারত। জনগণ বিক্ষুব্ধ হলেও সরকার এর প্রতিকার করছে না। এর পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট ও করিডোর আদায় এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তার আঙিনা বানাতে চাচ্ছে। এটা হলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলবে।
এসব কারণেই বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে বন্ধু মনে করে না। নিরপেক্ষভাবে জনমত যাচাই করলে তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে। ভারত বাংলাদেশকে প্রায় চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে আছে। যদি কখনো এ দেশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়, তাহলে একমাত্র ভারতই করবে। এটা বড়ই দুঃখের বিষয় যে, জনগণ ভারতকে বন্ধু মনে না করলেও সরকার ভারতকে শুধু বন্ধুই মনে করে না, জনগণের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক তারা কখনো ভারতের কোনো মন্দ আচরণের প্রতিবাদ করে না। বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্যে ভারত যা দাবি করে তা সবই তারা বিনা দ্বিধায় দিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের স¡ার্থের বিরোধী হলেও ভারতের স¡ার্থ বজায় রাখতে তারা অতি উ[?]সাহী। অথচ, বাংলাদেশের জনগণ দৃঢ়ভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে।
প্রিয় দেশবাসী,
আপনাদেরকে সম্বোধন করে আবার কিছু বলার সুযোগ পাবো কিনা জানি না। তাই, প্রাসঙ্গিকভাবে আমি যা বলতে চাই তার প্রয়োজনে পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে দু’এক কথা উল্লেখ করতে হয়।
চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, যুদ্ধের পর তারা ভারতবর্ষকে স¡াধীনতা দিবে। মি. গান্ধি ও মি. নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস দল থেকে দাবি করা হয় যে, ভারতীয় জাতীয়তা ও সেক্যুলার গণতন্ত্রের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারত ‘এক রাষ্ট্র’ হবে, কারণ ভারতের সকল ধর্মের মানুষ এক জাতি। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের মত নেতারা দাবি করলেন যে, ‘মুসলিমরা আলাদা জাতি’। ৪০ কোটি ভারতবাসীর রাষ্ট্রে ১০ কোটি মুসলমান ৩০ কোটি হিন্দুর শাসনাধীন হলে মুসলিমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে না। তাই, মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোকে ভারত থেকে আলাদা করে পাকিস্তান কায়েম করার আন্দোলন হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ১০ কোটি মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়ার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের জন্ম হয়।
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আদর্শিক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়। এই বিভেদ বঞ্চনা থেকেই পৃথক হওয়ার ধারণার জন্ম। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ বিভক্ত ভারত ও বিভক্ত পাকিস্তানের উত্তরসূরী। এই বিভক্তির ফলে আমরা আলাদা জাতিসত্তা ও স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিুত হয়।
বিগত ৬০ বৎসর ধরে ভারতে মুসলমানদের যে দুর্দশা চলছে, ভারত বিভক্ত না হলে বাংলাদেশের মুসলমানদেরও একই দুরবস্থা হতো। পাকিস্তান হওয়ার কারণেই সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের এত ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছিল। ভারত বিভক্ত না হলে ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশ ভূখণ্ডের যে উন্নতি হয়েছে তা কখনো হতো না। আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি ৪৭ এর দেশ বিভাগের ফল হিসেবেই।
বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, রাসূল (সা)-কে মহববত করে এবং কুরআনকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। রাসূল (সা) কুরআনের জীবন বিধান বাস্তবে চালু করেই ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করেন। তিনি ইসলামকে শুধু কতক অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম মনে করেননি। মানবজাতির পার্থিব সুখ-শান্তি ও আখিরাতে সাফল্যের জন্যই আল্লাহ কুরআন নাযিল করেন।
বাংলাদেশে ধর্মহীন সেক্যুলার মতবাদ কায়েম করা হলে কংগ্রেসের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে কোনো পার্থক্য আর থাকবে না এবং ভারত বিভাগ ও আমাদের আলাদা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের কোনো যৌক্তিকতা থাকবে না। এই কারণেই আমরা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, সুখী ও ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। তাহলেই আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ হবে। তা না হলে এদেশ একদিন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কবলে পড়ে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের সেক্যুলার সরকার আমাদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার ভিত্তি ইসলামকে এ দেশের জনজীবন থেকে উচ্ছেদ করে কংগ্রেসের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনের পথই পরিষার করছে।
আমি মুসলিম দেশবাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানাই, যেন তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে এ দেশে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েমের জন্য জান-মাল দিয়ে প্রচেষ্টা চালান। কারণ, এটা ঈমানেরই দাবি এবং এটা স্বাধীনতারও একমাত্র গ্যারান্টি।
প্রিয় দেশবাসী,
দেশ বর্তমানে এক কঠিন সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান ব্যতীত দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই, দলমত নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এসব জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে কাজ করে যাওয়া একান্ত জরুরি।
এখন বিভাজনের সময় নয়- জাতীয় বৃহত্তর ঐক্যের সময়। দেশের অগ্রগতি অর্জনের স্বার্থে আমাদের পেছনে তাকানোর সময় নেই; আমাদেরকে সামনে অগ্রসর হতে হবে। আমি কামনা করি, বর্তমান সরকার এবং ভবিষ্যতেও যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিবেন তারা দলমত নির্বিশেষে সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে কাজ করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। আমি দোআ করি, দেশের শাসকগণকে আল্লাহ যেন হীন দলীয় স্বার্থ ও হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে সঠিকভাবে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার তাওফীক দেন, আইনি সাম্যের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে যা করণীয় তা তারা করেন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নাগরিকদের অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, এবং বয়স্ক, দরিদ্র ও ইয়াতিমদের ব্যাপারে বিশেষ যতবান হন। তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে, এ দেশের মানুষকে আধুনিক, সুশিক্ষিত, দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দাবি করছি যে, আমি কখনও কোন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলাম না। এক শ্রেণীর অন্ধ স্বার্থান্বেষী মহল আমাকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিগত প্রায় ৪০ বৎসর যাবত এ ধরনের ঘৃণ্য অপপ্রচার করে জনমনে আমার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুট করছে। আজ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য কোথাও কোনো মামলা হয়নি। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার অন্যায়ভাবে আমার জন্মগত নাগরিকত্ব অধিকার হরণ করলেও পরবর্তীতে, ১৯৯৪ সালে, সুপ্রিম কোর্টের সর্বসম্মত রায়ে আমি আমার জন্মগত নাগরিক অধিকার ফিরে পাই এবং আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এখন নতুন করে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আবার সেই একই অভিযোগের অবতারণা করা হচ্ছে।
আমি জেল, জুলুম, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। মৃত্যু অত্যন্ত স্বাভাবিক, অনিবার্য। একদিন সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আখিরাতে বিশ্বাস করি, তাক্বদির বিশ্বাস করি। আরও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই হয় না এবং তিনি যা করেন তা বান্দাহর কল্যাণের জন্যই করেন। সুতরাং, আমি আমার মৃত্যু নিয়ে সামান্যও শঙ্কিত নই। আমি নিশ্চিত, আমি এ দেশের মানুষের অকল্যাণের জন্য কোনো কাজ কোনোদিনই করিনি। নিরপেক্ষ তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার হলে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবো, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। যারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন, তারাও জানেন যে, আমি দোষী নই- এ সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে যে রকম প্রহসনের বিচার হচ্ছে তেমন হলে তো আর কোনো বক্তব্য থাকে না।
আমার দীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মজীবনে সারাদেশে ব্যাপক সফর করেছি। জনগণের মধ্যেই বিচরণ করেছি। উন্নত নৈতিক চরিত্রে ভূষিত হওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে তা কখনো জনগণ বিশ্বাস করবে না। আমাকে ফাঁসি দিলেও জনগণ আমাকে আল্লাহর সৈনিক হিসেবেই গণ্য করবে, ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে, বলতে চাই যে, দেশের মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য আমি নিজের সারাজীবন উৎসর্গ করেছি। আত্মপ্রচার বা আত্মপ্রতিষ্ঠা কখনোই চাইনি। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমিই একমাত্র কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় দলীয় প্রধানের পদ থেকে অবসর নেয়ার মত নজির সৃষ্টি করেছি। কোনো প্রতিদান বা স্বীকৃতি কারো কাছে কোনোদিন চাইনি; এখনো চাই না। আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট। তবে আফসোস, দেশ এবং জাতির জন্য যা চেয়েছি তা দেখে যেতে পারবো কিনা। দোআ করি, আল্লাহ এই দেশকে এবং দেশের মানুষকে হেফাযত করুন, দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করুন। আল্লাহ তাআলা দেশের মানুষকে দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের মুক্তি দান করুন, আমীন।
আপনাদের নিকট দোয়া চাই। আল্লাহ তাআলা যেন আমার নেক আমলগুলো মেহেরবানী করে কবুল করেন, যাবতীয় গুনাহখাতা মাফ করেন এবং আখিরাতে সাফল্য দান করেন।
(আমার উপর জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্বের কোনো দায়িত্ব নেই। তাই আমার এই বক্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত। এর সাথে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই।)