চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সবুজ শ্যামল পাহাড়ে ঘেরা আর শতজাত পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের নিদর্শন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার জঙ্গলপট্টি নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আবহমান বাংলার সকল অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করেই পরিচালিত হয়ে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন মতাদর্শের ইতিবাচক রাজনীতি চর্চাও এখানে স্থান পেয়েছে বেশ গুরুত্বের সাথে। স্বাধীনতার পর থেকেই জ্ঞান চর্চার এই বিদ্যাপীঠে নতুন আঙ্গিকে পদযাত্রা শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। আদর্শিক মানদণ্ডে উতরাতে না পেরে স্তিমিত হয়েছে অনেকেই। তবে ক্ষমতার মোহে আদর্শকে বিলীন করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার আর শোষণ নিপীড়নের প্রয়াসে আজও তৎপর অনেক সংগঠন। সিট দখল, হল দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সাংবাদিক নির্যাতন আর শিক্ষক লাঞ্চনার ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য আর মর্যাদাকে কলুষিত করেছে বারংবার। এদিকে ইসলামি ছাত্রশিবির নিজেদেরকে আদর্শিক মানদণ্ডে যোগ্য প্রমাণ করে এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি পত্রপল্লবের সবুজের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সেই আশির দশক হতে শিক্ষায় উন্নয়ন, সংস্কৃতিতে মননশীলতা আর রাজনীতিতে সহনশীলতার নীতি অবলম্বন করে পরিচালিত হয়ে আসছে এই সংগঠন । আর এ সংগঠনের প্রত্যেক সদস্য ব্যক্তিজীবনে বিনম্র আচরণ ও ইসলামি জীবনাদর্শকে ধারণের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এবং স্থান করে নিয়েছে প্রত্যেকের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
১৯৮২ সালের চাকসু নির্বাচনে ইসলামি ছাত্রশিবিরের জসিম-গাফফার পরিষদের পূর্ণ প্যানেলে বিজয় সারা দেশে তুলেছিল তুমুল আলোড়ন। ইসলামি ছাত্রশিবির ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এই দুটি নাম যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু ছাত্র শিবিরের এই অগ্রযাত্রাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি বাতিলপন্থিরা। বারে বারে আঘাত করে থামিয়ে দিতে চেয়েছে এর অগ্রযাত্রা। ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা ও কালেমার পতাকাকে উড্ডীন রাখতে গিয়ে বারবার শিবির কর্মীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ভূমি। ইসলাম বিদ্বেষী অশুভ শক্তির চক্রান্তের শিকার হয়ে হারাতে হয়েছে ১০ টি তরুণ তাজা প্রাণ। এছাড়াও পঙ্গুত্ব বরণ আর অসমাপ্ত শিক্ষাজীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে আরো অসংখ্য ভাইকে। তবে শত বাধাবিপত্তি সত্তেও ক্ষণিকের জন্যও বন্ধ হয়নি কুরআন প্রতিষ্ঠার এই কাজ। আল্লাহর দ্বীন কায়েমের স্বপ্নগুলো যেন যুগযুগ ধরে মিশে আছে এই সবুজ ভূমির প্রতিটি ঘাসে, গেঁথে আছে প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও কলংকময় অধ্যায় রচিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনেই ধারালো অস্ত্রের উপর্যুপরি নির্মম আঘাতে হত্যা করা হয় শিবিরের তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী হল শাখার সেক্রেটারি মাসুদ বিন হাবিব ও জীববিজ্ঞান অনুষদ শাখার প্রচার সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদকে। এমন কি হয়েছিল সেদিন? যে কারণে দু-দুটি তাজা প্রাণ ছিনিয়ে নিল হায়েনার দল?
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২। অন্যান্য দিনের ন্যায় শাটল ট্রেনে করে আসা শিক্ষার্থীদের ঘিরে পরিপূর্ণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধুবান্ধবদের গল্পগুজব আর আড্ডায় মুখরিত ঝুপড়িগুলো। যথাসময়ে ক্লাস শুরু হয়েছে প্রতিটি অনুষদে।
সকাল ১০:০০ টা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী শিবির কর্মী ফিরোজ হাসনাত ও আলামিনের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয় তাদেরই সহপাঠী ছাত্রলীগ কর্মী শাহীন। কারণ হিসেবে জানা যায় তাদের অন্য এক সহপাঠী নাজমুল ফরায়েজীকে নিয়মিত ক্লাসে রেসপন্স (response) করার অভিযোগ এনে মারধর করা ও ক্লাসে আসা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী শাহীন। কিন্তু আমরা যতটুকু জানি জ্ঞান অর্জনের এই শিক্ষাঙ্গনে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকা, শিক্ষকদের সাথে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করা এবং ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকদের নিকট জেনে নেওয়াই একজন ভালো ছাত্রের বৈশিষ্ট্য। অথচ একি দেখছি ! ছাত্রলীগ কর্মীর মানদণ্ডে নাকি এটি অপরাধ! আর সেই অপরাধে ক্লাস শেষ হলেই শিবির কর্মীদের উপর আক্রমণের জন্য জড়ো হতে থাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
দুপুর ১২:৩০, সম্ভাব্য আক্রমণের খবর জেনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন শিবিরের কলা অনুষদ শাখার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, চেষ্টা করেন সমঝোতার। কিন্তু না! কিসের সমঝোতা?
জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা যাদের দৃষ্টিতে অপরাধ, সমঝোতা কি তাদের সমাধানের পথ হতে পারে? ক্ষণিকের মধ্যেই প্রায় ৪০ জন সশস্ত্র ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একত্রিত হয় কলা অনুষদের ঘটনাস্থলে। কথাবার্তার ফাঁকেই ছুরিকাঘাত করে আহত করে শিবিরের কলা অনুষদ শাখার সাথী আবদুল্লাহ নাঈমকে। কলা অনুষদ শাখার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ভাইকে ধাওয়া করে নিয়ে যাই বিজ্ঞান অনুষদের দিকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার হাতে। তাকে হত্যা করাই যেন উদ্দেশ্য ছিল তাদের। কিন্তু তৎকালীন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন জনাব আবুল কালাম আজাদ স্যারের সাহসিক ভূমিকার কারণে ভেস্তে যায় তাদের পরিকল্পনা। আহত ভাইদের সংবাদ শুনে ঘটনাস্থলের দিকে মিছিল নিয়ে ছুটে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান ভাই সহ আরো কিছু সহযোগী। তারা এসে আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এদিকে ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি দেখে রক্তপিপাসুর দল চলে যেতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেইট গোলচত্বরের দিকে। সেখানে একত্রিত হতে থাকে বহিরাগতসহ অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার বাহিনী। প্রশাসনের সবুজ সংকেত পেলেই দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করবে শাহ আমানত হল। এই খবর জানতে পেরে শিবির কর্মীরা অবস্থান নেয় সোহরাওয়ার্দী হল চত্বরে। কিছুক্ষণ পরেই রিভালবার,রামদা আর চাপাতি নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। ঈমানের বলে বলিয়ান আল্লাহর সৈনিকরা লাঠিসোটা আর ইট পাথর নিয়েই গড়ে তোলে প্রতিরোধ। তিন তিনবার আক্রমণ করতে আসলেও প্রতিবারই প্রতিহত হয় বাতিলের দল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরনের সংকটময় অবস্থায় যখন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা অবৈধভাবে হল দখলের উদ্দেশ্য আক্রমণ চালাচ্ছে তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ কেউ তাদের কে দমানোর পরিবর্তে বরং উসকে দেন। প্রকাশ্যে ছাত্রলীগকে মদদ দিয়ে শিবির নিধনে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর মইনুল ইসলাম। তাছাড়া প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রাখে আরো অনেকেই। ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশাসনের কর্তব্যরত শিক্ষকদের ভুমিকা কি এমন হতে পারে? এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও পুলিশের নীরব দর্শকের ভুমিকায় আরো বেপরোয়া হতে থাকে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। তারা শিবির কর্মীদের লক্ষ্য করে ক্রমাগত পাথর ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে তাৎক্ষণিক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শিবির নেতা জাহাঙ্গীর আলম। আর তাই সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করতে সম্মিলিতভাবে তাদের ধাওয়া করে শিবির কর্মীরা। অবশেষে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় স্টেশন মসজিদ সংলগ্ন দেওয়ালের পাশে। এভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিরোধের পর কিছুসংখ্যক ছাত্রশিবির কর্মী এগিয়ে এসে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হল সংলগ্ন পাহাড়ের পাশের রাস্তায়। এদিকে শাহ আমানত হল দখলে ব্যর্থ হয়ে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নং গেইট দিয়ে প্রবেশ করানো হয় বিপুল পরিমাণ পুলিশ। তারা অবস্থান নেয় শিবির কর্মীদের ঠিক পেছনে। শিবির কর্মীদের সামনে ছাত্রলীগ আর পেছনে পুলিশ,এই বুঝি মঞ্চায়িত হতে যাচ্ছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের নাটক। আর দেরি নয়,আকস্মিকভাবে পেছন থেকে শিবির কর্মীদের উপর লাঠিচার্জ করে বর্বর পুলিশবাহিনী। দিগবিদিক শূন্য হয়ে পড়ে ইসলামি আন্দোলনের কর্মীরা। ঠিক সেই সময় পুলিশের সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত শিবির কর্মীদের ওপর সামনের দিক থেকে পিস্তল, রামদা ও চাপাতি নিয়ে আক্রমণ করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। শারীরিক আকৃতিতে ছোট মুজাহিদকে ধরে ফেলে তারা। চাপাতি ও রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয় তার মাথা ও সমস্ত দেহে। দ্বীনি ভাই মুজাহিদের ওপর এই অতর্কিত আক্রমন দেখে থমকে দাঁড়ান মাসুদ ভাই। হাতে থাকা লাঠি নিক্ষেপ করে চেষ্টা করেন মুজাহিদ কে আক্রমণ করতে থাকা সন্ত্রাসীদের বিচ্ছিন্ন করতে। কিন্তু তা হয়নি বরং সন্ত্রাসীরা সম্মিলিত ভাবে আক্রমণ করে মাসুদ ভাইয়ের উপর। মুজাহিদদের ন্যায় একইভাবে চাপাতি ও রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে তার মাথা ও সমস্ত শরীর জুড়ে। আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত মুজাহিদ ও মাসুদ ভাই লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। আহ! কি নির্মম! এমন নৃশংসতা কি কোন মানুষের কাজ হতে পারে? মাসুদ ও মুজাহিদ ভাইয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি হচ্ছে রক্তে রঙিন। শত শত পুলিশ ও সাংবাদিকদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুইজন মেধাবী ছাত্রের উপর এমন নির্মমতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রচিত হয় এক কলংকময় অধ্যায়। এই কি সেই মাসুদ? যে কিনা কিছুক্ষণ পূর্বেও ব্যস্ত ছিলো আহত ভাইদের শুশ্রূষার জন্য তুলা ও স্যাভলন নিয়ে। অথচ এখন তিনি নিজেই মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী। আহত মাসুদ ও মুজাহিদকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল এম্বুলেন্স। কিন্তু কোথায় সেই এম্বুলেন্স? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ইশারায় ততক্ষণে সবগুলো এম্বুলেন্সকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পাসের বাইরে। এ যেন বর্বরতার এক নতুন সংস্করণ, আহতদের মৃত্যুই যেন কাম্য তাদের। অনেক খোজাখুজি করে অবশেষে একটি পরিত্যক্ত রিকশাভ্যানে করে আহত ভাইদের পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে। তখন মাসুদ ভাই কিছুটা নড়াচড়া করলেও মুজাহিদ একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হয়তো তখনই তার পবিত্র আত্মা পাড়ি দিয়েছে জান্নাতের পথে। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার থেকে সিএনজি দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। কত অকালেই ঝরে গেল দুটি সুবাসিত তাজা প্রাণ। পবিত্র আত্মারা উড়ে গেছে জান্নাতের পথে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। পৃথিবীর জীবন থেকে অনন্ত জীবনের দিকে।
প্রিয় দুই ভাইকে হারিয়ে শিবিরের নেতাকর্মীরা যখন শোকে মুহ্যমান তখনই পুলিশ ছলচাতুরির মাধ্যমে আমানত হল গেইট থেকে গ্রেফতার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি ইমরুল হাসান,সাংগঠনিক সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান,সোহরাওয়ার্দী হল সভাপতি নূর হোসাইন রিয়াজ ভাই সহ এগারো জন নেতা কর্মীকে। এ যেন জুলুম আর নিষ্ঠুরতার এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। খুনীদেরকে গ্রেফতার না করে উল্টো শহীদের সাথীদেরকেই গ্রেফতার করলো প্রশাসনের আজ্ঞাবহ পুলিশ বাহিনী। দুইজন ছাত্রের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো চট্টগ্রাম শহর জুড়ে। প্রতিবাদ থামানোর উপায় হিসেবে এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। ভ্যাকেন দেওয়া হয় সবগুলো হল। এদিকে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে নিহত মুজাহিদুল ইসলামকে নিজেদের কর্মী দাবি করে লাশ নিয়ে রাজনীতির এক ঘৃণ্য নজির স্থাপন করে ছাত্রলীগের খুনিরা। দ্রুত পোস্ট মর্টেম করে লাশ হস্তান্তর করলে আন্দোলনের প্রকোপ আরো বেড়ে যাবে এই শংকায় ওয়াসার সরবরাহ পানি না থাকার অজুহাত দেখিয়ে পোস্ট মর্টেমের কাজ বন্ধ রাখা হয়। সারা রাত লাশ দুটো রেখে দেওয়া হয় মেডিকেল মর্গে। অথচ শহীদের শোকার্ত সাথীরা তখনও অপেক্ষার প্রহর গুনছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে। শেষবারের মতো দেখবে প্রিয় দুটি মুখ,জানাজা সম্পন্ন করবে সকলে মিলে আর শেষ বিদায় জানাবে প্রিয় ভাইদের। না! পুলিশের বাধায় সাথীদের শেষ ইচ্ছাটুকুও পূরণ হলো না। অবশেষে পরদিন ০৯ ফেব্রুয়ারি সকালে পোস্ট মর্টেমের পর কড়া পুলিশ প্রহরায় শহীদ মাসুদ ও মুজাহিদ ফিরে গেলেন তাদের নিজেদের বাড়িতে মায়ের কাছে। তবে বড্ড অচেনা বেশে প্রাণহীন নিস্বার দেহে।
শহীদদের লাশ তাদের গ্রামের বাড়ি পোঁছালেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাদের স্বজনরা। কিন্তু এ কেমন নির্মমতা। আওয়ামী পেটুয়া পুলিশ বাহিনী সেখানেও করলো হস্তক্ষেপ। প্রিয়জন হারানোর শোকে অশ্রুও নাকি ঝরাতে পারবেনা শোকাহত স্বজনেরা! শহীদদের বাড়ির পথে বসানো হল পুলিশি পাহারা। দূর দূরান্ত থেকে শহীদদের শেষ বিদায় জানাতে আসা আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠী কেউই রেহাই পায়নি পুলিশের হয়রানি থেকে। প্রশাসনের এমন নির্মমতার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়ে উপস্থিত ছাত্রজনতা। তাদের প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন। অবশেষে জানাজার মাধ্যমে হাজারো জনতা সেদিন অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানিয়েছিল তাদের প্রিয় দুই সাথীকে।
শহীদ মুজাহিদ ভাইয়ের লাশ কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিলাম জানাজার মাঠে। জানাজা শেষে কবরস্থ করার প্রক্রিয়ায়ও অংশগ্রহণ করেছিলাম। চোখ বেয়ে দু-এক ফোঁটা পানি আসলেও হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কষ্টগুলো ছিল অপ্রকাশিত। প্রিয় ভাইয়ের কবরে মাটি টেন কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছিলাম সেদিন। কিছুতেই সেখান থেকে আসতে চাচ্ছিল না মন। কবরস্থ করার কাজ শেষে কবরের পাশে মুজাহিদ ভাইয়ের পিতা দাঁড়িয়ে ছিলেন সাথে ছিলাম আমরা অল্প কয়েকজন। প্রত্যেকেই শহীদের পিতার সাথে কোলাকুলি করে চেষ্টা করেছিলাম সান্তনা দেওয়ার। কিন্তু সন্তান হারানোর ব্যথা কি আর চাইলেই ভুলা যায়। মুজাহিদ ভাইয়ের লাশ যখন বাড়িতে পৌঁছালো প্রত্যক্ষ করেছিলাম ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মুজাহিদ ভাইয়ের মায়ের বিলাপ। আমার সোনা, আমার সোনা বলে পাগলের মত বিলাপ করছিলেন তিনি। আর কিছুই বলতে পারছিলেন না।
শহীদ মুজাহিদ ভাইয়ের পিতা সন্তানের লাশ কবরস্থ করে সেদিন রাতেই সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী হাটহাজারী থানায়। রাতে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখার পর উপরের নিষেধাজ্ঞা আছে বলে মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা। পরবর্তীতে শহীদ মাসুদ বিন হাবিব ভাইয়ের পিতা মামলা করতে আসলেও একি ঘটনার শিকার হন । সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে যেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে দুজন পিতাকে তা ইতিহাসের পাতায় কাল অধ্যায় হয়ে থাকবে। যে আওয়ামী নিষ্ঠুর পাষণ্ডরা কেড়ে নিল দুই-দুটি তাজা প্রাণ,তারা কি পারবে তাদের ফিরিয়ে দিতে? পারবে কি শহীদ মাসুদ ও মুজাহিদের মত দুটি আদর্শ ও চরিত্রবান মানুষ উপহার দিতে এই সমাজকে? যে মাসুদ বিন হাবিবের রাতের শেষ অংশ কাটতো আল্লাহর দরবারে সেজদারত অবস্থায়। যার সালাত সালাত ডাকে ঘুম ভাঙ্গতো সোহরাওয়ার্দী হলের শিক্ষার্থীদের। যিনি সবাইকে ডাকতেন সুন্দর নামে। যে ছিল সকলের প্রিয়ভাজন।
তারা কি পারবে ফিরিয়ে দিতে সেই মুজাহিদকে? যে হাসিমাখা মুখে দ্বীনি আন্দোলনের দাওয়াত দিয়ে বেড়াতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের। যার শেষ রাতের কান্নায় ঘুম ভেঙে যেত রুমমেটদের। না! তারা পারবেনা। তারা পারে শহীদ মুজাহিদ ও মাসুদের যে নত মস্তিষ্ক আল্লাহকে সিজদা করতে ভালোবাসতো, সেই মস্তিষ্ককে আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন করতে। তারা পারে শহীদ মুজাহিদ ও মাসুদের মায়ের ন্যায় অসংখ্য মায়ের কোল খালি করতে। আজ শহীদ মাসুদ ও মুজাহিদ নেয় তবে আজও অমলিন আছে তাদের আদর্শ। তাদের সহযোদ্ধারা সেই আদর্শকে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। শহীদের রক্ত একদিন অবশ্যই কথা বলবে। শহীদ মুজাহিদ ও মাসুদ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এই ময়দানে ইসলামী আন্দোলন অবশ্যই বিজয়ী লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।।।