গেল মাসে দেশে আবহাওয়ার ইতিহাসে ৭৬ বছরের মধ্যে টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভেঙেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসনের নামে কৃষি জমি ধ্বংস করা, অবাধে বৃক্ষ নিধন, রাজনৈতিক প্রভাবে জলাশয় ভরাট ও দখল এর অন্যতম কারণ। এসবের মাধ্যমে নগরগুলোকে কংক্রিটের শহরে পরিণত করা হচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ নগর গরমের সময় একদিকে দাবদাহে পুড়ছে, অন্যদিকে বর্ষায় ভয়াবহ পানিবদ্ধতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ। যা তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে, সেই সাথে বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ড এর প্রভাব। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৯ সাল কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকা ছিল ৬৪.৯৯ ভাগ। ২০০৯ সালে বেড়ে হয় ৭৭.১৮ ভাগ। আর ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশে। ২০২৩ সালে বিআইপির করা আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২৮ বছরে ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে জলাভূমি নেমে এসছে মাত্র ২.৯ শতাংশে। যদিও একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা।
সূত্র মতে, এক সময়ের সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো ঢাকা যেন হারিয়ে ফেলেছে তার শ্যামলিমার সৌন্দর্য। ঢাকায় একদিকে যেমন বায়ুদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। এবছর গত মাসে দেশের ৭৬ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। হঠাৎ করে এ তাপপ্রবাহ অনেকটা নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ঢাকার বর্তমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল। বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বায়ুদূষণের নগর হিসেবে রেকর্ড করেছে ঢাকা। যেখানে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে, ঠিক একই সময়ে গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর শিক্ষক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এ তিন কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক কারণের ভেতরে রয়েছে পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজন বন নষ্ট হওয়া, উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় বাণিজ্যিক কারণে কার্বন নিঃসরণ ও জ্বালানি পোড়ানো বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এর জন্য বাংলাদেশ খুব বেশি দায়ী না হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরই পড়ছে। দ্বিতীয় আঞ্চলিক কারণটি হলো হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া।
হিমালয়ের বরফে রিফ্লেক্ট হয়ে তাপমাত্রা পুনরায় বায়ুম-লে ফিরে যেত। কিন্তু এখন বরফ গলে যাওয়ার কারণে সেখানে কঠিন পাথর দেখা যাচ্ছে। ফলে এ পাথরে ধারণকৃত তাপমাত্রা বাতাসের মাধ্যমে আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং এক ধরনের দাবদাহ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বাড়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা স্থানীয় কারণের, যা স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এ স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা বাড়ার প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া। শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাস্তার বিভাজনের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে বায়ুম-লে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জলাধার মাটির পরিবর্তে বালি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বাড়ায় ভূমিকা রাখছে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি, যেটি প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এছাড়া নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পোড়ান। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়ার আরেক কারণ হলো যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো। বর্জ্যের ভেতরে থাকা প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন দূষিত গ্যাস ও মাইক্রো প্লাস্টিক বস্তুকণা বাতাসে মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। বাতাসে ভাসমান এই প্লাস্টিক কণাগুলো তাপ ধরে রেখে বায়ুম-লকে উত্তপ্ত করে তুলছে। রাজধানীর অধিক যানবাহন ও যানজট সমস্যাও তাপমাত্রা বাড়াতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় ৫২ লাখ গাড়ি, যার এক-তৃতীয়াংশ ফিটনেসবিহীন চলাচল করছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে ইঞ্জিন হতে প্রচ- পরিমাণে তাপ নির্গত হয়, যা বাতাসের সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে শহরের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে। ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে থাকে। এরপর যখন তা রিলিজ করে তখন তা নগরে তাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। নতুন করে তৈরি বহুতল ভবনগুলোয় অতিরিক্ত গ্লাসের ও এসির ব্যবহার এবং ভবনের ভেতরের সরু রাস্তা তাপমাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমান নগরায়ন, শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমই তাপমাত্রা বাড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শহরে বসবাসকারী মানুষ। তীব্র তাপপ্রবাহ শহরগুলোর জন্য বেশি বিপজ্জনক এবং প্রতিবছর শহরে ক্রমাগত ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়েন্স সেন্টারের ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতি বছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এ ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা কমাতে উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ এ ক্ষতি ১০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে গরমকালের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় অনুমান করা হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের এ ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার বিভাজনে শোভাবর্ধনকারী গাছ ছাড়াও ভূমির ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন উপকারী বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। ছাদবাগান বাড়াতে হবে। জলাভূমির পরিমাণও বাড়াতে হবে। দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্য কমাতে হবে। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
এদিকে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-র উদ্যোগে রাজধানীর বাংলামোটরস্থ প্ল্যানার্স টাওয়ারের বিআইপি কনফারেন্স হলরুমে অনুষ্ঠিত ঢাকায় দাবদাহঃ নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয় শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে ইনস্টিটিউট এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা মহানগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও দাবদাহের প্রভাবের মূলে ভূমি আচ্ছাদন (সবুজ, পানি ও ধূসর বা কংক্রিট আচ্ছাদন) এর মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, কংক্রিট এর পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা অনুপস্থিত, কাচ নির্মিত ভবন ও এসি নির্ভর ভবনের নকশা তৈরি, খাল-পুকুর ভরাট, দখল ও ধ্বংস, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, বনায়ন না করাসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহ কর্তৃক জলাশয়-জলাধার-সবুজ এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণে নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশপাশি বায়ু দূষণে সৃষ্ট অতি ক্ষুদ্র কণার কারণে নগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার বাতাসে উত্তাপ বাড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস। ময়লার ভাগাড়, ইটভাটা,যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে তৈরি হচ্ছে গ্যাস।
অনুষ্ঠানে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পুরো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে যার মূল কারণ মূলত ঢাকা শহরের আশেপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার এবং নগরায়নের নামে চালানো ধ্বংসযোগ্য।
পরিকল্পনাবিদ মোঃ রেদওয়ানুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে পাঁচ থেকে দশ শতাংশ জনগণ মূলত এসি ব্যবহার করে থাকে, যা আমাদের ঢাকা শহরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ পাশাপাশি আমাদের জলবায়ুর ক্ষতি সাধন করছে। সরকারের উচিত এ সকল বিলাসবহুল পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং জনগণকে তা মানার জন্য বাধ্য করতে সরকারকে আহ্বান জানান।
অন্যদিকে বষায় ব্যাপক পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। মাত্র ত্রিশ মিনিটের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বৃষ্টি হলে রাজধানী ঢাকার এমন জনদুর্ভোগের চিত্র নতুন নয়। বছরের পর বছর এমন দুর্ভোগের সাক্ষী নগরবাসী। অথচ প্রতি বছরই পানিবদ্ধতা নিরসনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও বলা হয় নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা। তবে বর্ষা এলেই ফুরিয়ে যায় এসব গলাবাজি। বেরিয়ে আসে পানিবদ্ধতার নগ্ন চিত্র। জানা যায়, একসময় রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। পরে রাজধানীর সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা গত ১২ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও কার্যকর কোনো সমাধান হয়নি। কারণ হিসেবে নদী, খাল-বিলের মতো প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও ভরাটকে দায়ী করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি তারা দায়ী করছেন অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণকেও। তারা মনে করছেন ঢাকা এখন এমন এক পর্যায়ে এসেছে যেখানে পানিবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব নয়। তবে সরকার থেকে নেওয়া প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে কাজ করলে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হবে বলে জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি ড্রেনেজ ব্যবস্থা থেকে শতভাগ সুবিধা পেতে জনগণকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ধারাবাহিকভাবে নগরের প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ধ্বংস করা হয়েছে, সবখানে কংক্রিটের ভবন গড়ে উঠেছে। এখন আসলে পরিকল্পনা করে বা প্রকল্প নিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে ঢাকায় দুই হাজারের বেশি পুকুর ছিল, সেগুলো এখন কীভাবে ফিরে পাওয়া যাবে? ঢাকা শহরকে যে অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে এখানে আসলে ভারী বর্ষার পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। এটি আসলে আমাদের এতোদিনের পাপের ফসল। এখন টাকা খরচ করে পানিবদ্ধতা সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা যাবে না।
পানিবদ্ধতা নিরসনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রেন ক্লিনিং এবং খাল পরিষ্কারে পাঁচ কোটি করে মোট ১৫ কোটি টাকা খরচ করবে। এ ছাড়া পাম্প হাউসের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পানিবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ নামের প্রকল্পে ব্যয় ধরেছে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
এছাড়া পানিবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার ও এডিবির মধ্যে ক্লাইমেট রেজিলেন্ট ইন্টিগ্রেটেড সাউথ ওয়েস্ট প্রজেক্ট ফর ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পে গত মাসে ঋণচুক্তি হয়েছে। এ ঋণটি এডিবির নমনীয় শর্তে পাওয়া গেছে, যার সুদের হার ২ শতাংশ এবং ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২৫ বছরে পরিশোধযোগ্য। এছাড়া অন্য কোনো চার্জ নেই। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল জানুয়ারি ২০২৪ হতে ডিসেম্বর ২০২৮ পর্যন্ত।
বাসযোগ্য নগরীর স্বপ্ন নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন-নগরীর অভ্যন্তরে এবং আশপাশের খাল, পুকুর ও জলাশয় নষ্ট করার ফলে ঢাকা শুকনো মওসুমে উত্তপ্ত, তেমনি বর্ষাকালে হয়ে পড়ছে পানিবদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত সময়ে পানিবদ্ধতাজনিত কারণে ঢাকার ক্ষতি হতে পারে ১১ হাজার কোটি টাকা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অতিবৃষ্টি হলে এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া খাল, পুকুর, জলাশয় পুনরুদ্ধারের বিষয়ে নানা আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করলেও তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। বরং ক্রমেই ঢাকার পূর্বদিকের নির্মাঞ্চল ভরাট হয়েছে। জলাভূমি ভরাট করে পরিবেশগত পরিকল্পনা ছাড়াই আবাসন নির্মিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, অতি তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ ভুল নগর দর্শন। সরকারকে নগর দর্শনের ধারণা বদলাতে হবে। প্রয়োজনে নদী ও খালের জমি অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করতে হবে।
রাজউকের প্রধান নগরপরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, সংশোধিত ড্যাপে ঢাকার সবুজ ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা গেলে শহরের তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সেই সাথে পানিবদ্ধতাও নিরসন হবে।