মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা একটি ঐতিহাসিক ‘ডেভেলপমেন্ট’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন সমাজে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যাও বেড়েছে। এর মধ্যে যে চরম দারিদ্র্য, তা বিশ্বব্যাপী গত ১০০ বছরে বেড়েছে। আগে দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু চরম দারিদ্র্য কম ছিল। তাই কল্যাণ অর্থনীতি বা মানুষের কল্যাণ নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করছিলেন, তারা ভাবছিলেন, কী করা যায়? সমাজতান্ত্রিক ধারায় একরকম চিন্তা করা হচ্ছিল; আবার পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থায় কী করা যায়, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। সেসব চিন্তা থেকেই আমাদের মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণের ধারণা আসে।
প্রচলিতভাবে বলতে হয় যে, এ বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অবশ্য অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছি, এ ধারণা মূলত বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদফতরই প্রথম দিয়েছিল। সুপারভাইজিং এবং গ্রুপ গঠনের ধারণাও মূলত তাদের। এটি তাদের এ জন্য বলছি যে, ড. ইউনূসের আগে তারা এটি করেছিল। আমি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখান থেকেই নিয়েছেন- আমি এটিও বলছি না। হয়তো তিনি নিজেই স্বতন্ত্রভাবে এটা উদ্ভাবন করেছেন। আর স্বতন্ত্রভাবে যে কেউ কোনো কিছু করতেই পারেন।
আমাদের দেশে যারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন, তারা মূলত কর্মক্ষম (efficient)। কিন্তু তাদের অভাব হচ্ছে, পুঁজি বা সম্পদের। অথচ তারা সামান্য পুঁজিতেই অনেক বড় কাজ করতে পারেন। এ ধারণার ভিত্তিই প্রকৃতপক্ষে ড. ইউনূস বিভিন্ন গ্রামে পরীক্ষা করেছেন। শেষে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তোলেন। সেখান থেকেই এ ধারণাটি আরো শত শত এনজিও নিয়ে নিয়েছে। সেই সাথে এ মডেলটি বিশ্বের অনেক দেশে নানা রকম সংস্থার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কতটুকু ছড়িয়েছে, তা অবশ্য হিসাবের ব্যাপার। এটি গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে থাকতে পারে।
আমরা আজ দেখি, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রায় তিন কোটি লোক এর আওতায় চলে এসেছে। অবশ্য তাদের এ ব্যবস্থা সুদভিত্তিক। আমরা আরো দেখতে পাই, তাদের প্রশাসনিক খরচ নানা কারণে বেশি। আরেকটি জিনিস লক্ষণীয়, মাইক্রোক্রেডিট আন্দোলন শুরু হয়েছে প্রায় ৪৫ বছর আগে। আর এর মূল্যায়ন শুরু হয়েছে গত ২৫ বছর ধরে। এখন মূল্যায়নে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মাইক্রোক্রেডিট আন্দোলনের মাধ্যমে যে ব্যাপক ‘বিপ্লব’ হবে এবং চরম দারিদ্র্য দূর হবে বলে মনে করা হচ্ছিল তা কিন্তু হয়নি। এমনকি মাত্র ২০ বছর আগে মাইক্রোক্রেডিটের ওপর বিশ্ব সম্মেলন হয়েছিল। তাতে বিশ্বের সব দেশের অর্থমন্ত্রীরা গিয়েছিলেন। এটি উদ্বোধন করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেখানে তারা ১০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল গঠনের অঙ্গীকারও করেছিলেন; কিন্তু বাস্তবে এক বিলিয়ন ডলারও পাওয়া যায়নি। এটি দুঃখজনক। এসব বড় বড় নেতা এ প্রতিশ্রুতিই বা কেন দিলেন, আর তা রক্ষাই বা কেন করলেন না- এটি একটি বড় প্রশ্ন। সঠিক অ্যাপ্রোচ বলব- একটি জাতির সর্বোপরি উন্নয়ন না হলে সে জাতি দারিদ্র্যমুক্ত হবে না। অর্থাৎ দেশের অবকাঠামো, কৃষি, শিল্প ও তার বিভিন্ন সেবা খাতকে উন্নত করতে হবে এবং সুষ্ঠু বণ্টনের দিকে নজর দিতে হবে, যাতে এর সুবিধা দরিদ্র সমাজ পেতে পারে। এটি হলো, দারিদ্র্য বিমোচনের এবং উন্নয়নের মৌলিক কৌশল। তার পরও অনেক লোক বঞ্চিত থাকবে। তাদের জন্য আমার মতে, মাইক্রোক্রেডিট মুভমেন্ট থাকা উচিত। কিন্তু এর চেয়ে উন্নত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা হওয়া দরকার। বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থায়, আমি মনে করি, ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে, যদিও এতে কোনো সিকিউরিটি নেয়া হচ্ছে না। কিন্তু উন্নয়নের স্বার্থেই ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
আমি মনে করি, অল্প ঋণ দিয়ে এটি আশা করা ঠিক নয় যে, দারিদ্র্য দূর হবে। ঋণ গ্রহীতাকে টাকার ওপর এতটা লাভ করতে হবে যাতে টাকা ফেরত দেয়া যায় এবং সেই সাথে নিজেরাও চলতে পারেন। কিন্তু অল্প টাকায় সুদসহ আসল টাকা ফেরত দেয়া এবং নিজের চলা অবাস্তবই মনে হচ্ছে। আর যদি এ পদ্ধতিই বজায় থাকে তাহলে টাকার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ঋণ পরিশোধের সময় বাড়াতে হবে। সেটি এক বছর নয়, বরং তিন বছরে পরিশোধ করার সময় দিতে হবে। তাতে ন্যূনতম ঋণ ফেরত দিয়ে নিজে কিছুটা লাভবান হতে পারবেন। এতে তারা নিজেরাও চলতে পারবেন। এতে ১২ মাসের ১২ কিস্তির জায়গায় ৩৬ কিস্তি হবে, কিস্তির পরিমাণও কমে যাবে। অনেক দিন ধরে একটি প্রজেক্ট গড়ে তোলারও সুযোগ পাওয়া যাবে। এটি নিজের জীবনধারণেরও অবলম্বন হতে পারে।
মুসলিম বিশ্বের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, ‘সুপারভাইজড জাকাত প্রদান ব্যবস্থা।’ কেন সুপারভাইজ করতে হবে? কারণ টাকা নিয়ে গরিবেরা খরচ করে ফেলেন। সুতরাং জাকাত ব্যবস্থায় টাকা দেয়ার পর সুপারভাইজ বা তত্ত্বাবধান করতে হবে। জাকাত তো আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না। এখানে সুপারভাইজড জাকাতের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সরকারিপর্যায়ে এটি হতে পারে। এমনও হতে পারে, যদি সরকার এটি না করে, তাহলে যেসব মাইক্রোক্রেডিট অর্গানাইজেশন ইসলামি নীতিমালা মেনে চলবে, তাদের জাকাত আদায় করার জন্য ভলান্টারি ভিত্তিতে কর্তৃত্ব দেয়া যেতে পারে। এটি গবেষণার বিষয়। কারণ আমাদের কাঠামোতে অনেক বিষয় কঠিন মনে হয়। কিন্তু কোনো একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তখন তা সহজ হয়ে যায়। ইসলামী ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, তখন এটি অসম্ভব কঠিন ব্যাপার বলে মনে হতো। কিন্তু এটি এখন ‘কিছুই না’ বলে মনে হয়। এর থেকে বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠিত জিনিসের সুবিধা কত বেশি। কাজেই প্রাইভেট সেক্টর থেকেও যদি জাকাত আদায় হয় অথবা সরকার বড় বড় ইসলামি সংগঠনকে জাকাত আদায় করার কর্তৃত্ব দেয়, তাহলে যারা মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম করতে চান, তারা সেই সম্পদকে সুপারভাইজড জাকাত ব্যবস্থায় দিতে পারেন। এতে এখানে সুপারভাইজড হবে, গ্রুপ থাকবে, সুপারভিশন থাকবে এবং প্রয়োজনীয় সবই থাকবে।
এখানে প্রশাসনিক খরচ কিভাবে বহন করা হবে, এ প্রশ্ন উঠতে পারে। এ জন্য ৫, ১০ কিংবা ১৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ নেয়া যেতে পারে শুধু প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ হিসেবে। এটিও বিধান আছে যে, প্রশাসনিক খরচ জাকাতের অর্থ থেকে নেয়া যায়। সুতরাং এটি একটি পয়েন্ট যে, জাকাত যে পরিমাণ আদায় করা হবে, তার ১০ শতাংশ খরচের জন্য রাখা যাবে (দেখুন, সুরা তওবা ৬০ আয়াত)।
বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিটও থাকতে পারে। কিন্তু এর দ্বারা সমস্যার সমাধান হবে না। আর ইসলামি জনতার পক্ষ থেকে দেখতে গেলে, এ ব্যবস্থা ঠিক নয়। এ দেশের জনগণ প্রধানত মুসলিম। তারা সুদকে মনে-প্রাণে চান না। তাই এ ব্যবস্থা যদি থাকে, তাহলে তিনটি পরিবর্তন আনতে হবে। প্রথমত, টাকার পরিমাণ বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, টাকা ফেরত দেয়ার সময় বাড়ানো, কিস্তির সংখ্যা বাড়ানো। তৃতীয়ত, এ জন্য শুধু প্রশাসনিক ব্যয় আদায় করা সার্ভিস চার্জ হিসেবে, যা শরিয়াহ বিশেষজ্ঞগণ বৈধ বলেছেন। অর্থাৎ তারা যা নিয়েছেন সেই ‘প্রিন্সিপাল’ দেবেন এবং প্রশাসনিক খরচও দেবেন। এটিকে আমরা ‘সার্ভিস চার্জ’ বলি। এর মধ্য থেকে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য দিকে, ইসলামি ব্যবস্থায় সুপাভাইজড জাকাত ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায়।
আর যদি সরকার খুব বড় আকারে করতে চায় যে, তারা এটিকে ফাউন্ডেশন করে দেবে- তাহলে এটিও করা যায় বিরাট আকারে। আর যদি সরকার তা না করে, তাহলে অন্তত যেসব এনজিও বা সংগঠন প্রমাণ করতে পারবে যে, তারা ইসলামি নিয়ম মেনে চলবে, তাদের কর্তৃত্ব দেয়া উচিত। তাদের সে অর্থ জাকাতের খাতগুলোয় ব্যয় করতে হবে। সেই সাথে সুপারভাইজ করতে হবে। অর্থাৎ জাকাত ফেরত নেয়া হবে না। শুধু তাদের গ্রাহকের ওপর একটি ব্যয় ধার্য করতে হবে, যা শুধু প্রশাসনিক খরচের জন্য হবে। সেটি তারা গ্রাহকের কাছ থেকে নেবেন। জাকাতের অন্যান্য শরিয়তসম্মত ব্যবহার অবশ্য অব্যাহত থাকবে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার