ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য আলোচনা করার আগে ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে কিছু আছে কি না সে প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন। এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের জানতে হবে, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে কেন ‘অর্থব্যবস্থা’ বলে উল্লেখ করা হয়। ‘পুঁজিবাদ’ বলতে আমরা নিশ্চয়ই কোনো দেশের বাজার, শিল্প, যোগাযোগব্যবস্থা প্রভৃতি বুঝি না। কেননা এসব তো সমাজতন্ত্রেও রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কেবল একটি নীতি, অর্থাৎ ব্যক্তির অর্থনৈতিক উদ্যোগ নেয়ার স্বাধীনতা ও মালিকানা যে ব্যবস্থায় থাকে তাকেই ‘পুঁজিবাদ’ বলা হয়ে থাকে। তেমনিভাবে সমাজবাদ বলতে আমরা ব্যাংকব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, কৃষি ইত্যাদি বুঝি না। কেননা এসব তো পুঁজিবাদেও রয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও উৎপাদনের নীতির কারণেই একটি অর্থব্যবস্থাকে ‘সমাজতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যদি একটি মাত্র প্রধান মূলনীতির কারণে কোনো অর্থব্যবস্থাকে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়, তবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি অর্থনৈতিক নীতিকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতি গড়ে ওঠে, তাকে নিঃসন্দেহে ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে গণ্য করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র অপেক্ষা অধিক ও বিস্তৃত অর্থনৈতিক নীতি ইসলাম দিয়েছে। ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, জাকাতের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা, সম্পত্তি বণ্টনের ইসলামি নিয়ম, হালাল ও হারামের বিস্তৃত সীমারেখা- এসব হচ্ছে ইসলামি অর্থনীতির মূলনীতি।
মদিনায় ইসলামি অর্থনীতির যে প্রথম মডেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তাতে শরিয়তের সীমার মধ্যে উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের স্বাধীনতা ছিল। এ স্বাধীনতাকে পুঁজিবাদী হিসেবে গণ্য করা যাবে না। কেননা মদিনার ইসলামি অর্থনীতি পুঁজিবাদের অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কাজেই ইসলাম পুঁজিবাদ থেকে কিছু নিয়েছে, এ কথা বলা যায় না।
ইসলামের অর্থনীতির লক্ষ্য কী, তা আমাদের কুরআন ও সুন্নাহ থেকে জানতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামি অর্থনীতির মূল লক্ষ্যগুলো নিম্নরূপ-
ক. অর্থনীতিতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা : ইসলাম অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে :
আল্লাহ তোমাদের আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করেছেন। (সূরা নাহল : আয়াত ৯০)।
লোকদের মধ্যে যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা করবে তখন ইনসাফের সাথে করবে। (সূরা নিসা : আয়াত ৫৮)।
সূরা নহলে যে আদেশ আল্লাহ তায়ালা করেছেন, তা যেমন ব্যক্তির ওপর প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য সরকারের ওপর। কাজেই সরকারকে শ্রমিক, কৃষকসহ সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর প্রতি সুবিচার করতে হবে। ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও একই দায়িত্ব। সূরা নাহলে আল্লাহ পাক কেবল সুবিচারের কথাই বলেননি, ইহসান বা সদাচরণের কথাও বলেছেন। সুবিচার পাওয়া তো প্রত্যেকের অধিকার। তবে সুবিচারের অতিরিক্ত জনগণকে দিতে হবে এবং সেটাই হচ্ছে ইহসান। সূরা নিসার আয়াতের আলোকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-মীমাংসা করার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা আদালত থাকতে হবে, যা সুবিচারের সাথে বিরোধের মীমাংসা করবে এবং অধিকার আদায় করে দেবে।
খ. নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ : নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের প্রতি আল্লাহ বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাকের ঘোষণা হচ্ছে :
পৃথিবীতে যারা নির্যাতিত ও বঞ্চিত, তাদের অনুগ্রহ করতে চাই। তাদেরকে পৃথিবীতে ইমাম (নেতা) ও উত্তরাধিকারী বানাতে চাই। তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন করতে চাই। (সূরা কাসাস : আয়াত ৫-৯)।
এটা হচ্ছে বঞ্চিতদের সম্পর্কে আল্লাহ পাকের সাধারণ নীতি। ‘উত্তরাধিকারী’ করার অর্থ হচ্ছে এমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া, যাতে বঞ্চিতরা পৃথিবীকে ন্যায়সঙ্গতভাবে উপভোগ করতে পারে। এ নীতির অর্থ হবে- এমন বেতন, সুবিধা, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বসবাসের সুযোগ; যা তাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। কাজেই ইসলামি অর্থনীতিতে এমন সব আইন, বিধি, নীতি, প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিশেষভাবে সুরক্ষিত হয় এবং কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয়। এটা করতে ব্যর্থ হলে সে অর্থনীতিকে বা সরকারকে আমরা সঠিক অর্থে ইসলামি অর্থনীতি বা সরকার বলতে পারি না। অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে, অন্য সব শ্রেণীর অধিকার নষ্ট করা হবে। অন্য সব শ্রেণীর ন্যায়সঙ্গত অধিকারও রক্ষা করতে হবে। কিন্তু সাধারণ লোকদের অধিকার (তারা দুর্বল হওয়ার কারণেই) প্রাধান্য পাবে।
গ. অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উৎখাত করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক যে সাধারণ নীতি দিচ্ছেন (যা অর্থনীতিতেও সমভাবে প্রযোজ্য) তা হচ্ছে :
যাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতা দেয়া হয় তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সালাত ও জাকাতের প্রতিষ্ঠা, মারুফ (সুকৃতি বা ভালো কাজ)-এর আদেশ দেয়া ও মুনকার (দুর্নীতি) প্রতিরোধ করা। (সূরা হজ : আয়াত ৪১)।
এ ধরনের বহু আয়াত কুরআন মজিদে রয়েছে। এসব আয়াতের ‘মারুফ’ ও ‘মুনকার’ শব্দকে সামগ্রিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে, কেবল নৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করলে চলবে না। এ আয়াতের আলোকে ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে এমন সব অথনৈতিক ব্যবস্থা, নীতি, পলিসি ও প্রতিষ্ঠান কায়েম করা; যাতে কল্যাণের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দূর হয়। একইভাবে এ আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে, অর্থনীতি থেকে এমন সব ব্যবস্থা, নীতি, পলিসি, প্রতিষ্ঠান, আইন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ, অপসারণ ও দূর করা; যার ফলে জনগণের অকল্যাণ হয়। এসব কাজ করা ইসলামি সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবশ্যকর্তব্য।
ঘ. জনগণের সহজ জীবন নিশ্চিত করা : আল্লাহ পাক নবী সা:-এর অন্যতম দায়িত্ব এভাবে নির্ধারণ করেছেন : তিনি তাদেরকে বোঝা থেকে মুক্ত করেন এবং যেসব শিকলে তারা আবদ্ধ, তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করে দেন। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৭)।
নবী করীম সা:-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিটি মুসলিম সরকার ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সেসব অন্যায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, বিধিবিধান ও নিয়মনীতি থেকে উদ্ধার করা; যা জনগণের জীবনের ওপর বোঝা ও শিকল হয়ে আছে। অপ্রয়োজনীয় রীতি-রেওয়াজ ও আইনকানুন মানুষের জীবনের স্বাধীনতা ও শান্তি নষ্ট করে। কাজেই ইসলামি সমাজ ও অর্থনীতিতে অপ্রয়োজনীয় কোনো বিধিবিধানের স্থান নেই। অবশ্য কোনটি প্রয়োজনীয় আর কোনটি অপ্রয়োজনীয়, তা ইসলামি সরকারের আইন পরিষদই ঠিক করবে।
ঙ. সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার
ইসলাম জনকল্যাণের জন্য সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার চায়। এ জন্যই ইসলাম পতিত জমি ফেলে রাখা সমর্থন করেনি। যে কেউ তিন বছর পর্যন্ত জমি ফেলে রাখলে নবী সা: তা নিয়ে নেয়ার জন্য বলেছেন। পতিত সরকারি জমি আবাদ করার জন্য হজরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ এক-দশমাংশ ফসল পাওয়ার বিনিময়ে হলেও চাষিদের কাছে বন্দোবস্ত দেয়ার জন্য গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই নীতি অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে গণ্য করতে হবে।
চ. সম্পদের যথাযথ বণ্টন : ইসলাম সম্পদের যথাযথ বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালার নীতিনির্ধারণী ঘোষণা হচ্ছে :
সম্পদ যেন তোমাদের ধনীদের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে না থাকে। (সূরা হাশর : আয়াত ৭)।
এ আয়াতের আলোকে ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে- আইন ও পলিসির মাধ্যমে সম্পদের সর্বাধিক বিস্তার ও বণ্টন নিশ্চিত করা এবং লক্ষ্য রাখা যেন, সম্পদ অতিরিক্ত পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ না হয়।
ছ. কল্যাণকর দ্রব্যের সর্বাধিক উৎপাদন : নবী সা:-এর দায়িত্ব হিসেবে আল্লাহ পাক বলেছেন : তিনি তাদের জন্য পবিত্র দ্রব্য হালাল করেন এবং অপবিত্র দ্রব্য হারাম করেন। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৭)।
এ আয়াতের আলোকে ইসলামের উৎপাদনব্যবস্থায় অপবিত্র দ্রব্যের কোনো স্থান নেই। সেখানে কেবল স্বাস্থ্যকর ও পবিত্র দ্রব্যই থাকবে। তাই ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো, জনগণের স্বার্থে স্বাস্থ্যসম্মত দ্রব্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং সব অকল্যাণকর দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানি, রফতানি, ব্যবসায় নিষিদ্ধ করা।
এ অধ্যায়ে ইসলামি অর্থনীতির কয়েকটি প্রধান লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব মূলনীতি কার্যকর করা ইসলামি সরকারের কর্তব্য। এসব কার্যকর করার ওপরই ইসলামি বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণ নির্ভর করে। আইন করেও যদি এসব লক্ষ্য অর্জিত না হয়, তাহলে বুঝতে হবে ইসলামের কোনো ভুল নেই; ভুল রয়েছে আমাদের আইন, বিধিবিধান ও আমাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে। এ কথা যেমন আজকের জন্য সত্য, তেমনি সত্য ভবিষ্যতের জন্যও।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার